সোমবার, ডিসেম্বর ১, ২০২৫
spot_img

মানুষ নয়, মনুষ্যত্বের মৃত্যুতে দুঃখ হয়

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী : প্রবাদ আছে ‘মানুষের জন্মে শিশু, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আদর্শ চেতনায় যিশু, না হয় পশু। কবি কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন, ‘গুণতে আমরা বৃদ্ধি পাচ্ছি গরু ছাগলের মত’। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদ বলেছেন, ‘পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ জানে না তারা মানুষ, জানলে অমানুষের কাজ করতো না’। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আমি মানুষের মৃত্যুতে দুঃখ পাই না, মনুষ্যত্বের মৃত্যুতে দুঃখ পাই। মানুষের মৃত্যু স্বভাবিক ঘটনা কিন্তু মনুষ্যত্বের নয়। পশুর গর্ভে পশুর জন্ম হয়, বৃক্ষের জন্ম বৃক্ষ হতে, কিন্তু মানুষের গর্ভে মানুষ হয় না। মানুষকে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। পশুকে পশু হওয়ার, বৃক্ষকে বৃক্ষ হওয়ার আহ্বান জানানো হয় না, শুধু মানুষকেই মানুষ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। যে ব্যক্তি মানুষ ও অমানুষের পার্থক্য বুঝে না, সে প্রকৃত মানুষ নয়। মানুষ ও অমানুষের পার্থক্য বুঝতে লাগে পরিশুদ্ধ হৃদয়। পশুকে অপশু বলে কেউ সম্বোধন করে না, কিন্তু আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে যখন পশুর কাজ করে তখন তাকে বলে অমানুষ। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আল্লাহ পাক হিংসা, ক্ষোভ, রাগ ও লোভ প্রদান করেছেন। এসব নিয়ন্ত্রণ করার বিধানও শিখিয়ে দিয়েছেন। কুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাধনা আর আরাধনা করার কথা বলা হয়েছে বারবার। মানুষ নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করাই প্রকৃত জিহাদ। অভ্যাসের দাস হলে মানুষ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আমরা প্রকৃত মু’মিন হতে পারবো। দূরে থাকতে পারবো সফল পাপাচার ব্যভিচার হতে।
আমরা এখন সর্বকালের সর্বাধিক পরিবর্তনের যুগে বাস করছি। বর্তমান পৃথিবী নামক গ্রহটি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। গত ২০ বছরে কমপক্ষে ২০ গুণ পরিবর্তন হয়েছে। আগামী ৩০ বছর পর এ পৃথিবী কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আমরা কেউ কল্পনা করতে পারছি না। এই পরিবর্তনের যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে হয়তো আমরা মঙ্গলগ্রহে ঘর নির্মাণ করতে পারি, কিন্তু সেখানে গিয়ে যদি মারামারি,হানাহানি, পাপাচার, ব্যভিচার, হত্যাকাণ্ড করি তবে সেটাকে উন্নতি বলা যাবে না। ফ্লাইওভার, ব্রিজ, রোড,বিমান বন্দর, ইমারত নির্মাণকে প্রধান উন্নতি বলা যাবে না, মানুষের মনের উন্নতি, দৃষ্টিভঙ্গির উন্নতি হলো সত্যিকারের উন্নতি। যা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে অর্জিত হয়। মানুষের মন হলো ‘পাওয়ার পয়েন্ট’। আলোর গতি সেকেন্ড তিন লক্ষ কিলোমিটার আর মনের গতি তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি। মনকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। বর্তমান যুগকে বলা হয় যান্ত্রিক সভ্যতার যুগ। এ যুগে কতশত যন্ত্র আবিস্কার হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কিন্তু মনকে পরিবর্তনের যন্ত্র এখনো আবিস্কার হয়নি। আত্মত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই মানুষ মনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
বর্তমান তরুণ ও যুব সমাজের চারিত্রিক চরম অবক্ষয় ঘটছে।এটা দিনে দিনে দ্রুত মারাত্মক রূপ ধারণ করে চলছে।যা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা আইন প্রয়োগ করে, নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে সমাধান করা যাবে না। কারণ এই সমস্যাটি যতটা শারীরিক তার চেয়ে বেশি মানসিক। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ৭০ ভাগ রোগ মানসিক, ৩০ ভাগ আঘাত জনিত ও জীবানুবাহী। এসব ব্যাধি দূর করতে মনের চিকিৎসা বেশি প্রয়োজন। দেহ ও মনের সমন্বয়ে মানুষের সৃষ্টি। দেহ মাটি আর রূহ আল্লাহর নির্দেশ বা নুর। মাটি নিম্নগামী আর রূহ ঊর্ধ্বগামী। মাটির বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে বেশি হলে মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়। আত্মার শক্তি প্রবল হলে মানুষ অনেক ঊর্ধ্বে চলে যায়। মানব পরিনত হয় মহামানব।
ব্যক্তি, সমাজ, দেশের বাইরের পরিবর্তন চাইলে ভেতরের পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়। বাইরের বড় ধরনের মহাবিপ্লব বা পরিবর্তন চান? তাহলে ভেতরটা পরিবর্তন করেন। বাইরে হয়ে যাবে মহাপরিবর্তন। বাইরের পরিবর্তন দ্বারা ভেতরের পরিবর্তন সম্ভব নয়।
মহান আল্লাহ পাক বারবার তাওয়া অর্জনের তাগিদ দিয়েছেন। ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। মানুষ তাকওয়ার মাধ্যমেই সকল অবিচার অপরাধ হতে বাঁচতে পারে। তাকওয়া হলো সকল ভালো কাজের উৎস এবং মন্দ কাজ হতে বিরত থাকার উপায়। যিনি তাক্ওয়া অর্জন করেন তিনিই ‘মোত্তাকি’। মোত্তাকি নিজে সৎ হয় মানুষকে সৎ কাজের প্রতি উৎসাহিত করেন।
‘তাকওয়া’ শব্দটি ছোট, অর্থ অনেক গভীর, সরল অর্থ আল্লাহ ভীতি। যে দেশে প্রকাশ্যে রাজপথে ঘুষ, দুর্নীতি হয়, সেদেশে আইন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ঘরে ঘরে চার দেয়ালের ভেতরের পাচাপার, ব্যভিচার, খুন নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন আল্লাহর ভয়। তাকওয়া মানে আল্লাহর ভয়। ভয় মানে তাঁর আদেশ মানা। তাঁর প্রতি অনুগত থাকা। সমাজে মানুষ কী বলবে সে ভয়ে আমরা অনেক পাপাচার করি না। অথচ আল্লাহ সবকিছু দেখছেন, তাঁর সামনে কী ভাবে পাপ করবো, এ ভীতির নামই তাকওয়া। অপরাধ বন্ধ করতে হলে সমাজ তাকওয়াভিত্তিক হতে হবে। সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। অপরাধ দমনে তাওয়াভিত্তিক সিসি ক্যামেরা অন্তরে স্থাপন করতে হবে। মনে রাখতে হবে ফেরেস্তারা আমার সবকিছু রেকর্ড করছে এবং মহান আল্লাহ পাক আমাদের গর্দানের শাহী রাগের চেয়ে নিকটে আছে, এটিই তাকওয়ার শিক্ষা।
তাকওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আড়াই শতাধিক আয়াত আছে। সূরা বাকারাতেই ‘তাকওয়া’ শব্দটি ত্রিশবার আছে। পবিত্র কোরআনের প্রায় বিধিবিধানের পর তাকওয়া ছাড়া ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ মুত্তাকিদের আমলই কবুল করেন। (সূরা মায়েদা, আয়াত: ২৭)। মানুষ তাওযার গুণেই মুত্তাকি হয়। মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত পবিত্র কোরআনে আরো ইবাদত করেছেন, ‘আল্লাহর কাছে (তোমাদের কোরবানীর) মাংস, রক্ত, কোনোটাই পৌঁছে না, পৌঁছে তাওয়া (সূরা হজ্ব, আয়াত: ৩৭)।
যে মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক তাওয়া সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন, তাকওয়া ছাড়া সে কোরআনও মানুষের কোনো উপকারে আসবে না বলে কোরআনের শুরুতেই মহান আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, ‘এই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকিদের জন্য হেদায়ত স্বরূপ। (সূরা বাকারা, আয়াত: ২)। মহান আল্লাহ পাক মানুষ হওয়ার জন্য আমাদের যেন তাকওয়ার মাধ‍্যমে মুত্তাকিদের অন্তর্ভুক্ত করেন।আমিন। লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক

সর্বশেষ

যুক্তরাষ্ট্র আ.লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক নিযুক্ত সঞ্জয় কুমার সাহা

পূর্বকাল ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক...

ইজারাদারদের দাবি, সাতকানিয়া দেওয়ানহাট বাজার পরিচালনায় সুশাসন নিশ্চিতকরণের

অনলাইন ডেস্ক: সাতকানিয়ার দেওয়ানহাট বাজার পরিচালনায় সুশাসন নিশ্চিতকরণের দাবী...

পাঠ্যপুস্তক

রতন চন্দ্র পাল, অতিথি লেখক: মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ...

আ.লীগের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য হলেন বিধান রক্ষিত

নিজস্ব প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক...

সাতকানিয়ার কেরানীহাটে আশ্-শেফা স্কুল এন্ড কলেজে নাতে রাসুল (সাঃ) প্রতিযোগিতা সম্পন্ন

এস এম আনোয়ার হোসেন, দক্ষিণ চট্টগ্রাম: পবিত্র রবিউল আউয়াল...
spot_img