ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী : ইসলাম অর্থ শান্তি এবং মুসলিম অর্থ শান্তিকামী। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা হয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সুবিচার দরকার এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠায় দরকার সুনাগরিক। পরিবার নামক ছোট প্রতিষ্ঠানটি নষ্ট হয়ে গেলে রাষ্ট্র নামক বড় প্রতিষ্ঠানটি নষ্ট হয়ে যায়,তাই সুবিচার প্রতিষ্ঠায় আমাদের পরিবারে সদস্যদের নীতি নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া দরকার।
বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচবার চ্যাম্পিন হয়েছে। অশিক্ষিত মূর্খদের কারণে সেরা দুর্নীতিরাষ্ট্র হয়নি। এখানে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে জাতির সেরা শিক্ষিতরাই। সর্বোচ্চ শিক্ষিতদের কারণে যদি সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র হয় তাহলে একথা বুঝতে আমাদের সমস্যর হয় না,শিক্ষায় মুক্তি আনতে পারে না, মুক্তি আনতে হলে সুশিক্ষা-আদর্শের শিক্ষাই প্রয়োজন।
আজ নৈতিক শিক্ষার অভাবেই প্রতারণা, ধোঁকাবাজি, ঠকবাজি বৃদ্ধি পাচ্ছে। একশ্রেণীর মানুষের দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠছে। এই অবৈধ সম্পদ পরিবার ও সমাজে শান্তি নয় দুর্ভোগেই নিয়ে আসছে। তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়াতে অসম্মান ও অশান্তি এবং পরকালে রয়েছে দোজখের কঠিন আজাব।
আমরা এখন শতকে। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে আমাদের বসবাস। এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কারণে প্রতি দশ বছর অন্তর অন্তর ভোগের সামগ্রি দ্বিগুণ হচ্ছে।প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা ৭ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে।ভোগের সামগ্রী পেতে আজকের ছাত্র-যুব সমাজ অস্থির হয়ে উঠছে।বিদায় হয়ে যাচ্ছে মানব মনে শান্তি।কারণ মানুষ ভোগের সামগ্রীর পিছনে ছুটতে ছুটতে জীবনকে উপভোগ করার কথা ভুলে গেছে। পশুপাখি জীবজন্তু ভোগ করে কিন্তু জীবনকে উপভোগ করতে পারে না। মানুষ ভোগও করে আবার উপভোগও করে। মানুষের জীবনে উপভোগের চেয়ে ভোগের মাত্রাবৃদ্ধি পেলে পশুত্বই বৃদ্ধি পায়। ভোগ করতে হাজার কোটি টাকার দরকার হয় কিন্তু জীবনকে উপভোগ করতে টাকার প্রয়োজন হয় না। একটি গান, কবিতা, নাত, হামদ, প্রার্থনা,ফুলে মুগ্ধতা ও চাদনী রাত, বাংলার প্রকৃতি আত্মস্থ করে জীবনকে উপভোগ করা যায়। আজ ভোগের সামগ্রীর বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের যুব সমাজকে অস্থির করে তুলছে, নতুন নতুন ভোগের সামগ্রী অর্জন করতে তারা বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। একদিকে পরিবার প্রথা ভেঙ্গে যাচ্ছে আর অন্যদিকে যেসব পরিবার আছে সেসব পরিবারে শাস্তি নেই।পরিবার ছিল শান্তির আশ্রয়স্থল। সে শান্তির নীড়ে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি। সন্তান-মা-বাবাকে হত্যা করছে, মা-বাবা সন্তানকে হত্যা করছে, ভাই বোনকে, বোন ভাইকে হত্যা করছে। কোথায় নীতি-নৈতিকতা ও আবেক আমাদের? যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’র সেরা কথা,’বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ,কেড়ে নিয়েছে আবেক’ বিজ্ঞান গতি দিছে কিন্তু আবেক কেড়ে নিছে, কথাটি আজ সত্য প্রমাণিত।
মুসলমানদের ঈমান হলো সবকিছুর মালিক মহান আল্লাহ পাক। এই ঈমান যে ব্যক্তির নিকট থাকবে সে বুঝবে, দুনিয়াতে আমার বলতে কিছুই নেই। তাঁর জীবনে অহংকার ও লোভ থাকবে না। যে অহংকার ও লোভ আমাদের সমাজে অনাচার ব্যবিচার পাপাচার সংঘাত বৃদ্ধি করছে।
বাংলাদেশের ৯০% ভাগ লোক ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তারা নামাজ রোজা হজ করে, কিছু কিছু মুসলমান যাকাত প্রদান করে, তারা আবার ঘুষ খায়, দুর্নীতিও করে।মুসলমান ইসলামের শান্তির বাণী আত্মস্থ করতে পারলে দুর্নীতিতে দিন দিন নিমজ্জিত হতে পারতাম না। একটা জাতি যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে তখন দুর্নীতিতে ডুবে যায়।
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, যারা দেশে-দেশে অবাধ্যতা প্রদর্শন, আর সেখানে বহু বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। অতঃপর তোমার প্রতিপালক তাদের উপর শাস্তির চাবুক হানলেন। (আল কোরআন: সূরা: ৮৯, আয়াত-১১-১৪)
আইন, অধিকার এবং আল্লাহর নির্দেশনা যারা বিরোধিতা করে দুর্নীতি করে, তাদের প্রতি মহান আল্লাহ পাক অসন্তুষ্ট হয়ে বিভিন্ন প্রকার শাস্তি প্রদানের ইঙ্গিত এই আয়াতে করিমায় প্রদান করা হয়েছে।
এখন লুঠেরা দুর্নীতিবাজরা সমাজে গর্ব করে বেড়ায়। তারা যেন আজ সমাজের হর্তাকর্তা বিধাতা। তাদের দাপটে ভালো মানুষ নেতৃত্ব থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আগে দুর্নীতি গোপনে করা হতো,বর্তমান প্রকাশ্যে দুর্নীতি করে গর্ববোধ করতে। আল্লাহ পাকের আইন অমান্য করে সিন্ডিকেট দ্বারা দ্রব্যমূল্য মজুদ করে দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে।মানুষকে বাঁচানোর জন্য যে ওষুধ প্রস্তুত করা হচ্ছে সেখানেও করা হচ্ছে ভেজাল। ভোগ্যপণ্যে মিশানো হচ্ছে ভেজাল, ঘুষ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি সমাজকে করছে গ্রাস। অথচ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বহুবার মানুষের অধিকার হতে বঞ্চিত না করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। পবিত্র কোরআনে তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা নিজেরা একজন অন্য জনের সম্পদ অন্যায় ভাবে গ্রাস করো না’। (আল কোরআন: সূরা: ২, আয়াত: ১৮৮)
মানুষ মানুষের ক্ষতি এবং হক নষ্ট করা সীমালঙ্ঘনের নামান্তর। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করে না’। (আল কোরআন, আয়াত: ১৯০, সূরা: ২)
দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতি হতে মুক্ত থাকার চেষ্টা জিহাদের সমতুল্য। এই পাপ হতে মুক্ত হওয়ার একমাত্র পথ আল্লাহ পাকের ভয়। পবিত্র কোরআনে তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘হ্যাঁ যে কেউ আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে এবং সৎকর্মপরায়ন হয় তার বিনিময় তার প্রতিপালকের নিকট রয়েছে এবং তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না’। (আল কোরআন: সূরা: ২, আয়াত: ১১২)
আমাদের সমাজে বহু অঢেল সম্পদের মালিক দেখতে পাই অথচ তাদের মনে শান্তি নেই। তারা অর্থ আয়ের জন্য উম্মাদ হয়ে পড়েছে। মনে কিসে শান্তি আসে তারা তা জানে না, হারাম রুজিতে শান্তি নেই, দুনিয়া এবং আখিরাতে আছে দোজখের আগুনের শাস্তি। হালাল রুজির ওপর সন্তুষ্ট থাকাই শান্তি। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘হে মানব মণ্ডলী! দুনিয়াতে যত কিছু হালাল এবং পবিত্র খাদ্যদ্রব্য রয়েছে তা হতে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের পথ অনুসরণ কর না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’। (আল কোরআন, সূরা ২. আয়াত: ১৬৮)
পৃথিবীতে মানুষ সুখী হতে চায় কিন্তু শয়তানের প্রতারণায় মানুষ সুখী হতে পারে না। অসুন্দর জিনিসকে শয়তান মানুষের কাছে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলে ধরে পথভ্রষ্ট করে, কারণ শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। আল্লহ পাক মানুষকে শয়তানের কুমন্ত্রনা হতে রক্ষা করুক।আমিন।
লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক


