আদালত প্রতিবেদক: আইনজীবি আলিফ হত্যা মামলায় আসামিপক্ষে বাইরের আইনজীবী দাঁড়াতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি। সোমবার বিকেল ৩টার দিকে চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এড. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী।
সংবাদ সন্মেলনে বলা হয়, চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণে বহিষ্কৃত ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের সমর্থকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে হওয়া মামলায় প্রায় ৭০ আইনজীবীকে আসামি করা হয়েছে। যেখানে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবীও রয়েছেন। ফলে সম্প্রতি কোতোয়ালী থানায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার চিন্ময়ের জামিন শুনানিতে গ্রেফতার আতঙ্কের ‘ভয়ে’ দাঁড়ায়নি কোনো আইনজীবী। শুধু তাই নয়, মামলার আসামি হওয়া এসব আইনজীবীদের বেশিরভাগই হামলার ভয়ে আদালতছাড়া। এছাড়া আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যায় আসামিদের পক্ষে আইনজীবীদের লড়াই না করার অনুরোধ জানানো হয়।
তবে আইনজীবী সমিতির দাবি, আলিফ হত্যা মামলার আসামিদের পক্ষে বাইরের আইনজীবী দাঁড়ালে বাধা দেবেন না তারা। জেলা আইনজীবী সমিতির কেউ আসামিপক্ষে লড়াই করলে তা হবে আলিফের রক্তের সাথে বেঈমানির শামিল। এছাড়া কোনো আইনজীবী আদালত চত্বরে হামলা-গ্রেফতারের ভয়ে আসছে পারছেন না এমন কোনো অভিযোগ পাননি সমিতির নেতারা।
আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে হত্যা মামলায় আইনজীবীদের না লড়ার অনুরোধে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এড. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমিতো বলিনি বাইরে থেকে আইনজীবী এনে ডিফেন্স করতে পারবে না। তবে হত্যা মামলার একটি নিয়ম আছে। হত্যা মামলার কোর্ট যখন চলবে তখন কোর্ট নিজেই একজন আইনজীবী নিয়োগ করবেন আসামিপক্ষে। এটাকে স্টেট ডিফেন্স বলে। যিনি মারা গেছেন তিনি আমাদের সমিতির সদস্য, তাই আমরা মনে করি তার রক্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আসামিপক্ষে দাঁড়িয়ে কেউ আসামি নির্দোষ এটা যেন না বলে সেই অনুরোধ করেছি। তবে আইনজীবী থাকবে না এমনটা বলিনি।
সংঘর্ষের ঘটনায় হওয়া মামলায় অনেক আইনজীবীকে আসামি করা হয়েছে, যারা ভয়ে আদালতে যাচ্ছেন না এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নাজিম উদ্দিন বলেন, কোনো আইনজীবীকে নাজেহাল করা হয়েছে, আদালতে যেতে দেওয়া হয়নি কিংবা হামলা করা হয়েছে—এমন কোনো অভিযোগ আমি পাইনি। মামলাটির আসামিদের মধ্যে যাদের নাম এসেছে বলে শুনেছি অধিকাংশই আদালতে তারা মামলা লড়ছে স্বাভাবিকভাবে আমি শুনেছি। কেউ যদি না আসে এটা ব্যক্তিগত বিষয়। অনেকেই আদালতের কার্যক্রম করছেন।
এদিন সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এড. মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক। এ সময় তিনি আইনজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১১টি দাবি উত্থাপন করেন।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, গত ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফকে উগ্র সন্ত্রাসী সংগঠন ইসকনের অনুসারীরা নির্মমভাবে কুপিয়ে, লাঠিপেঠা করে নির্মমভাবে হত্যা করেন। তার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও তার প্রাণহীন দেহের উপর পৈশাচিক ভাবে আঘাত করতে থাকেন। এমন নজিরবিহীন পৈশাচিক হত্যাকান্ড বিভিন্ন মিডিয়া ও আপনাদের মাধ্যমে সারাবিশ্ব ও বাংলাদেশের জনগণ অবলোকন করেন এবং স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ ও হতবাক হয়ে যান। দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ দেশব্যাপী এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, পেশাজীবী সংগঠন আদালতে কর্মবিরতী পালন, প্রতিবাদ সমাবেশ, শোক র্যালী, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেন। দেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুছ এ হত্যাকান্ডের তদন্ত ও দ্রুত যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
রাজ্জাক বলেন, আমরা হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই বলে আসছি ওই দিনের ন্যাক্কারজনক এ ঘটনার সময় আদালত এলাকার নিরাপত্তায় নিয়োজিত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় সন্ত্রাসীরা এহেন নির্মম হত্যাকান্ড, মসজিদ, আদালত, ল’ চেম্বার, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী জনগণের গাড়ি, দোকানপাট ভাংচুর করার সুযোগ পেয়েছিল। আদালত অঙ্গনে দীর্ঘসময় চিন্ময় দাশকে প্রিজনভ্যানে রাখা হয় এবং তিনি প্রিজনভ্যান থেকে হ্যান্ডমাইক দিয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে তার অনুসারিদের ন্যাক্কারজনক এ ঘটনার নির্দেশ দেন। যার ফলশ্রুতিতে আইনজীবী সমিতির ইতিহাসে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা সংগঠিত হয়। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষে ১১টি দাবি তুলে ধরে এই আইনজীবী বলেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িত যে সকল ইসকনের সন্ত্রাসী এখনো গ্রেফতার হয়নি তাদেরকে গ্রেফতারপূর্বক দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করে দোষীদের সর্বোচ্চ শান্তি মৃত্যুদণ্ডের জন্য প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি, মসজিদ, আইনজীবীদের চেম্বার, গাড়ি ও দোকানপাট ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি প্রদানের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি, সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে হত্যা মামলাসহ অন্যান্য মামলাসমূহে অন্যতম আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, হত্যাকাণ্ডে দায়েরকৃত মামলাসমূহের চার্জশীট প্রদানপূর্বক দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার নিষ্পত্তির কার্যকর ব্যবস্থা করতে হবে, ঘটনার দিন আদালত এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হব।
তিনি বলেন, শহীদ অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যাকারীদের পক্ষে কোন বিজ্ঞ আইনজীবীকে মামলা পরিচালনা না করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি, নির্মম ও পরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ডটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত না করে সকল প্রকার অপপ্রচার ও চক্রান্ত থেকে বিরত থাকার জন্য দেশী-বিদেশী সকল মহলের প্রতি উদার্র আহ্বান জানাচ্ছি, শহীদ অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি, নিরাপরাধ কোন ব্যক্তিকে হয়রানী না করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি, আদালত অঙ্গনের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য প্রশাসনের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি, আদালত অঙ্গনের সুদীর্ঘকালের সৌহার্দপূর্ণ সম্প্রীতি বজায় রাখা ও সহঅবস্থান নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।
