ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী : আমরা এখন একুশ শতকে সূর্য উদয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়। এ যুগ প্রচণ্ড জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তির ক্ষমতার বিকশিতের যুগ। প্রতিযোগিতার যুগ। আগে প্রতিযোগিতা হতো দেশের একটি অঞ্চলে।সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা হতো জাতীয় পর্যায়ে।এ যুগে কেউ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে সারা পৃথিবীর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তি অর্থনীতির বাজার বিশ্বে মাত্র একটি, দুটি নেই।
এখনো আমরা বুঝতে চাই না,পরীক্ষার খাতার প্রতিযোগিতায় বেশি নাম্বার পেলাম কিন্তু জীবনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে সফল বলা যাবে না। আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফার্স্টবয়দের নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি হয় কিন্তু জীবনের পরীক্ষায় যাঁরা সফল হয়েছে তাদের নিয়ে তেমন কিছু হয় না। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনকেও এ বিষয়টি পীড়া দিয়েছে। যা তিনি তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘দ্য কান্ট্রি অব ফাস্ট বয়েজ’ এ উল্লেখ করেছেন। ফাস্ট বয় কিন্তু অমর্ত্য সেন কখনো হয়নি। পরীক্ষায় পাস করা আর জীবনের পরীক্ষা পাস হওয়া এক বিষয় নয়। পাঠ পরবর্তী জীবন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সে সময় সম্পর্কে যে উদাসীন সে ব্যক্তি সফল মানুষ হতে পারে না। আজকাল পত্রিকায় দেখতে পাই, পরীক্ষার নাম্বারের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের জঘন্য সিদ্ধান্ত ‘আত্মহত্যা’র পথ পর্যন্ত গ্রহণ করছে।
বিশ্বের সেরা ধনী বিল গেটস বলেছেন, ক্লাসের যে ছেলেটি ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে প্রথম হতো সে আমার মাইক্রোসফ্ট কোম্পানীর ভাইস প্রেসিডেন্ট। আর যে ছেলেটি (বিল গেটস) এ সবের অত্যাচারে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছিল সেই ছেলেটি ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা।
বিল গেটস কিন্তু হার্ভার্ডে কয়েকটি বিষয়ে ফেল করেছিল। যারা পাস করে তাদের অনেকই আজ তাঁর প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত। আমাদের মনে রাখতে হবে বিল গেটস কিন্তু ধন কুবের হওয়ার জন্য সফটওয়ার আবিষ্কার করেনি। পৃথিবীটাকে সহজ করার জন্য তিনি কাজটি করেছিলেন। সে কাজটিই তাঁকে পৃথিবীর সেরা ধনীতে পরিণত করেন।
সাহিত্যিক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ‘সফলতা নয়, জীবনকে সার্থক করো। ফুলের রং সফলতা, সৌরভ হলো সার্থকতা, অনেক জীবন শিক্ষার অর্থে সফল হতে দেখি কিন্তু সার্থক হয় না।
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেছেন, ‘কুমড়া ফুল থেকে ফল হয়, এটা হলো সফলতা, আর গোলাপ ফুল থেকে ফল হয় না, বীজ হয় না, কিন্তু তার আছে সৌন্দর্য ও সৌরভ। এটা হলো সার্থকতা।
বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার ছিলো,হয়তো ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার কাতারে যাবে।একসময় এদেশের মানুষের মাথাপিছু আরো বাড়তে পারে।বহু উন্নয়ন একদিন ঘটতে পারে।সে উন্নতিকে প্রকৃত উন্নতিতে রূপ দিতে না পারলে আমরা জাতি হিসেবে টিকে থাকবো কী ভাবে! আমরা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ অনকে দেশ দেখেছি। বর্তমান যুদ্ধরত সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, লিবিয়ার মাথাপিছু আয় অনেক বেশি ছিল। আজ কিন্তু রাষ্ট্রগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত।আমাদেরও একই অবস্থা হবে কিনা তা বলা যায় না।আমাদের উন্নতিকে মানসিকতার উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে না পারলে, পিছিয়ে যেতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে মানসিক ও মানব সম্পদ উন্নয়ন জরুরি। মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে হলে মানবিক মূল্যবোধের উন্নতি করতে হবে। দৃষ্টি রাখতে হবে বাহ্যিক উন্নতিকে যেন মনুষ্যত্বের অবনতির দিকে নিয়ে না যায়।
আজ শিক্ষার অভাব নেই,দীক্ষার অভাব আছে। শিক্ষার সাথে দীক্ষার সমন্বয় না ঘটলে জীবন সফল হয় না। শিক্ষা গতি আনে, দীক্ষা আদর্শ শিখায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে প্রচুর কিন্তু দীক্ষাগুরুর আছে অভাব। মানুষ গড়ার শিল্পী আজ কয়জন আছে।এই শিল্পীরা আজ ছাত্র কতৃক অপমানিত হয়।আমাদের আর বাকি থাকলো কী!
আধুনিক যুগের সেরা বিজ্ঞানী আলভার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, জীবনটা শিক্ষার জন্য, যে দিন কিছু শিখতে পারি না সেটা আমার জীবনের অংশ নয়। মহানবী হয়রত মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগেই বলেছিলেন, এমন কোনদিন নেই যেদিন আমি নতুন কিছু শিখিনি। একব্যক্তি হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)’র নিকট জানতে চাইলেন, আপনার বয়স কত? তিনি জানালেন, দুই বছর। তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, কেন আপনি মিথ্যা বলেছেন? জবাবে ঈমাম সাহেব বললেন, আমি ঈমাম জাফর সাদিক (রা.)’র সান্নিধ্যে এসেছি দুই বছর। এই দুই বছর আমার জীবন, বাকী সময় আমার জীবন নয়। প্রকৃত শিক্ষা আত্মার,আধ্যাত্মিকতার। তিনি তা জাফর সাদিক (রা.)’র নিকট পেয়েছিলেন। মহাকবি মিল্টন বলেছিলেন, ‘প্রকৃত শিক্ষা শরীর, মন, আত্মার সমন্বিত উন্নত করে’।প্রকৃত পক্ষে যে শিক্ষা, শরীর, মন, আত্মার উন্নতি করে না তা জাতিকে উন্নত করতে পারে না।যে মেধাবীদের কারণে দেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয় সেটি কুশিক্ষা।কোন অশিক্ষিত মানুষের কারণে দেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়নি। পৃথিবীর কোথাও হয় না। প্রকৃত আধ্যাত্মিক আলোকিত শিক্ষা যাদের নেই, তাদের কারণেই দেশ বিপদগ্রস্ত হয়।
রাজপথের আন্দোলনে পরিবর্তন আনে।তার সাথে দরকার ভিতরের পরিবর্তন ।ভিতরটা পরিবর্তন করে দিলে বাইরেরটা পরিবর্তন হয়ে যাবে। মন হলো ‘পাওয়ার পয়েন্ট’। এই পাওয়ার পয়েন্ট পরিবর্তন করলে সমাজ পরিবর্তন হবে।
মহানবী হযরত মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘শরীরের মধ্যে এমন একটি অংশ আছে যা পরিশুদ্ধ হলে পুরো মানব শরীর পরিশুদ্ধ হয়ে যায়’। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘চিত্ত (মন) হতে চেতনা, চেতনা হতে কর্ম’। চিত্ত যদি পরিশুদ্ধ না হয় সুস্থ চেতনা জাগ্রত হবে না। সুস্থ চেতনায় সুন্দর কাজ সম্পাদন হয়। সুন্দর কাজ সমাজ ও দেশ সুন্দর করে। কথায় বলা হয়, ‘শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব, বিপ্লব আনে মুক্তি’। প্রকৃত পক্ষে আত্মার শিক্ষাই পরিশুদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করতে পারে। আমরা পরিবর্তন চাইলে আগে নিজের মনের পরিবর্তন করতে হবে। মনের পরিবর্তন ছাড়া সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। এ পৃথিবী নামক গ্রহটি তারাই পরিবর্তন করেছে যা আগে নিজকেই পরিবর্তন করেছে।
আমরা পরিবর্তনের জন্য কেমন শিক্ষা চাই। প্রাণের শিক্ষা, হৃদয়ের শিক্ষা। মনীষী শরৎচন্দ্র বলেছেনে, ‘শিক্ষা মানে লেখাপড়া জানা নয়, জ্ঞানের প্রসার হৃদয়ের কালচার’। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষা যেন তথ্য না দেয় সত্যও’। সত্য জ্ঞান আলোকিত জ্ঞান। যে জ্ঞানই আনতে পারে প্রকৃত মুক্তি।
লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক


