শনিবার, ডিসেম্বর ১৩, ২০২৫
spot_img

মানুষের মৃত্যুতে নয় মনুষ্যত্বের মৃত্যুতে কষ্ট হয়

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী:সাহিত্যিক আসহাব উদ্দিন আহমদ লেখেছেন, ‘আমাদের যুগে আমরা কাঁচা ঘরে বাস করে লেখাপড়া করেছি পাকা, আজকের যুগে পাকা ঘরে বাস করে লেখাপড়া করে কাঁচা’। আমরা আধুনিক হচ্ছি। সবকিছুর উন্নতি হচ্ছে, ফ্লাইওভার হচ্ছে, ব্রীজ, টানেল হচ্ছে,মেট্রো, বিমানবন্দর, আধুনিক বিল্ডিং সবই হচ্ছে। এ- প্লাস, গোল্ডেন এ-প্লাস এবং শিক্ষার হার বাড়ছে, কিন্তু প্রকৃত মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে। বাড়ছে জনসংখ্যা কমছে মানুষ। বাড়ছে পরীক্ষার্থী কমছে শিক্ষার্থী। মনকে জাগানোর আলোকিত শিক্ষা দিনে দিনে কমছে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘শিক্ষার লক্ষ্য হল মনুষ্যত্ব লাভ, জীবনকে সবদিক থেকে উদ্বোধিত করা, প্রাণকে সম্পূর্ণ ভাবে জাগানো, আপনাকে বিকশিত করা, পরিপূর্ণ হওয়া’। বর্তমান আমাদের শিক্ষা শিক্ষিত সমাজকে বিপরীত অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত বলেছেন, আনুষ্ঠানিক মেধাবীরা আত্মকেন্দ্রীক ও দুর্নীতিগ্রস্ত হন। দেশের বিসিএস পরীক্ষার্থীদের আধিকাংশ মেধাবীরা চাকুরী পছন্দ করে কাস্টমস, এরপর কর বিভাগ, তারপর পুলিশ, শিক্ষা বিভাগ পছন্দের তালিকায় ১৬ বা ১৭ নম্বরে। কারণ শিক্ষায় ‘আয়’ কম। এক জরিপে দেখা গেছে, বেশীর ভাগ ভালো মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত নন। শিক্ষিত হলেও পরীক্ষায় ভালো ফল করেনি। কিন্তু এরা মানুষের কল্যাণে কাজ করছে ।
আমি শিক্ষক হিসেবে দেখেছি, বেশীর ভাগ ভালো ছাত্র খারাপ মানুষ। বেশির ভাগ ‘মাঝারি’ ছাত্র ভালো মানুষ’। মনুষ্যত্বে শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা না থাকলে কোন জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। মূল্যবোধের শিক্ষা আস্তে আস্তে আমাদের হতে হারিয়ে যাচ্ছে।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর ‘মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘শিক্ষার আসল কাজ জ্ঞান পরিবেশন নয়, মূল্যবোধ সৃষ্টি। জ্ঞান পরিবেশন মূল্যবোধ সৃষ্টির উপায় হিসেবেই আসে। তাই যেখানে মূল্যবোধের মূল্য দেওয়া হয় না, সেখানে শিক্ষা নেই’।
আমাদের সন্তানরা রবীন্দ্র-নজরুল-শেক্সপিয়র, আইনস্টাইন, নিউটন হতে চায় না, সবাই এখন বিল গেটস, জেফ বেজোস, বার্নার্ড আর্নল্টের, মার্ক জুকারবার্গ হতে চায়। অঢেল অর্থ বিত্তের মালিক হতে চায়, মানুষ হতে চায় না।
অভিভাবকরাও সন্তানদের ধনী হওয়ার জন্য রসদ যোগায়। কিন্তু দেশপ্রেম মানবপ্রেম জাগরণের রসদ যোগায় না। আমরা চিন্তা করি না, মানবপ্রেম দেশপ্রেম বর্জিত সন্তান কখনো পিতৃপ্রেমে বা মাতৃপ্রেমে প্রেমিক হাতে পারে না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আগাধ দেশপ্রেম মানব প্রেম ছিল বলেই প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে দামোদর নদী সাঁতরিয়ে পার হয়ে অসুস্থ মাকে দেখতে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা, আর সমস্ত শিক্ষা তার অধীন।’
আমাদের সমাজ লোভের কারণে মনুষ্যত্বের শিক্ষা হারিয়ে ফেলছে। মনুষ্যত্বের বিষয়ে অসাধারণ কথাটি বলেছেন, পশ্চিম বঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায়। তিনি বলেছেন, ‘লোভী ব্যক্তিরা অনেক ক্ষেত্রে তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু লাভ করে বটে, কিন্তু হারায় তার সবচেয়ে বড় সম্পদ মনুষ্যত্ব’। বিজ্ঞান প্রযুক্তি চরম উন্নতির কালে মনুষ্যত্বে অধোগতিতে মানসিক কষ্ট পাই। মনীষী শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, মানুষের মৃত্যুতে আমি দুঃখ পাই না, মনুষ্যত্বের মৃত্যুতে আমি দুঃখ পাই’। মানুষের জন্ম হয়েছে মৃত্যু বরণ করার জন্য। কিন্তু মনুষ্যত্বের মৃত্যু হওয়ার কথা ছিল না।
পশুকে পশুত্ব অর্জনের জন্য স্কুল কলেজে যেতে হয় না, কোন ধ্যান জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। প্রকৃতির নিয়মে পশুত্ব অর্জিত হয়। কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্য জ্ঞান ধ্যান সাধনার প্রয়োজন হয়। মনুষ্যত্ব অর্জুনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। দুর্গম পথ পারি দিয়ে মানুষ তার মনুষ্যত্বকে বিকাশ ঘটাতে হয়।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক সূরা আর রহমানের শুরুতেই ঘোষণা করেছেন,’ পরম করুনাময় দয়ালু। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন কোরআনে। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তাকে শিখিয়েছেন ভাষা’। (সূরা আর রহমান: ১-৪)।
এখানে মানুষ সৃষ্টির আগেই কোরআন শিক্ষার কথা উল্লেখ করেছেন। কারণ মানুষ যতক্ষণ নীতি নৈতিকতার কোরানিক শিক্ষা অর্জন করবেন না ততক্ষণ মানুষ মানুষ হবে না। শুধু রক্ত মাংসের মানুষ হলে মানুষ বলা যায় না। একজন মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে এখানে বড় একটি পার্থক্য।
আমরা আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দিই, ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর দরকার নেই’। অথচ যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছেন তাঁদের ত্যাগের কারণেই বাংলাদেশ এতটুকু আসা-এগিয়ে যাওয়া। তাদের ত্যাগের কারণেই এদেশে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দেশের ইতিহাস আর মানুষ দিন শেষে তাদেরকে মনে রাখবে।
পরীক্ষায় পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বিষয় নয়। দেহের মৃত্যুর চেয়ে আত্মার মৃত্যু অনেক বড়,তা আমরা চিন্তা করি না। দেহের মৃত্যুতে আমরা কান্না করি কিন্তু আত্মার অপমৃত্যুতে ভীত হওয়া দূরের কথা, উৎফুল্ল হই।
কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদের নিকট এক সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন, কেমন আছেন? উত্তরে তিনি বললেন, বেঁচে আছি। এমন উত্তর কেন দিলেন তার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, বহু মৃত মানুষ জীবিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি, অথচ তাদের আত্মা মরে গেছে। তাই বলছি, বেঁচে আছি। আজ প্রচুর মানুষ বেঁচে থাকলেও তাদের নিকট মনুষ্যত্ব নেই। তারা মানুষ রূপী পশু। মানুষ জন্মে শিশু, নৈতিক শিক্ষায় যিশু, না হয় পশু। পশুত্বের অবসান হোক। মনুষ্যত্বের জয় হোক। লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক

সর্বশেষ

যুক্তরাষ্ট্র আ.লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক নিযুক্ত সঞ্জয় কুমার সাহা

পূর্বকাল ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক...

ইজারাদারদের দাবি, সাতকানিয়া দেওয়ানহাট বাজার পরিচালনায় সুশাসন নিশ্চিতকরণের

অনলাইন ডেস্ক: সাতকানিয়ার দেওয়ানহাট বাজার পরিচালনায় সুশাসন নিশ্চিতকরণের দাবী...

পাঠ্যপুস্তক

রতন চন্দ্র পাল, অতিথি লেখক: মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ...

আ.লীগের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য হলেন বিধান রক্ষিত

নিজস্ব প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক...

সাতকানিয়ার কেরানীহাটে আশ্-শেফা স্কুল এন্ড কলেজে নাতে রাসুল (সাঃ) প্রতিযোগিতা সম্পন্ন

এস এম আনোয়ার হোসেন, দক্ষিণ চট্টগ্রাম: পবিত্র রবিউল আউয়াল...
spot_img