নিজস্ব প্রতিবেদক: শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা জুড়েই মশার উৎপাতে বন্দর নগরীর চট্টগ্রামের মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠেছে।বিশেষ করে বর্ষার শুরুতেই মশার উৎপাত ফের বেড়েছে।
সিটি করপোরেশন মাঝে মাঝে মশা মারার নানা তোড়জোড় দেখালেও দিনশেষে সেগুলো অকার্যকর হয়েই থাকছে। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে বর্ষা, এসেছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রার্দুভাবের মৌসুম। এদিকে চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি থেকে মে) আক্রান্ত হয়েছেন ১৬৯ জন।
সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্ষা শুরু হলেও তাদের মূল অগ্রাধিকার ছিল কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ। কোরবানির ছুটির পর তারা মশা নিধনের বিশেষ কর্মসূচিতে নামবেন। তবে কবে নাগাদ সেই কার্যক্রম শুরু হবে, এর কোনো সদুত্তর নেই চসিকের কমকর্তাদের কাছে।
চসিকের কর্মকর্তাদের মতে, জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রার্দুভাবের মৌসুম শুরু হলেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে গিয়ে সেটা মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই প্রবণতা বিবেচনায় রেখেই তারা মশা নিধনের জোরালো পদক্ষেপ নেবেন। তবে মশা নিধনের ওষুধ, লোকবলসহ আনুষাঙ্গিক সরঞ্জামের এবার কোনো ঘাটতি নেই বলে তারা দাবি করেছেন।
এর আগে ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। এবারও মশার তীব্র উপদ্রবের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে শঙ্কিত নগরবাসী। সিভিল সার্জনের কার্যালয় ডেঙ্গুর প্রভাব মোকাবিলায় এখনই মশা নিধনসহ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন এখনো হাত গুটিয়ে আছে। মশা মারার কার্যক্রমে দৃশ্যমান কোনো গতি নেই, রুটিন কাজেই তারা সীমাবদ্ধ।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, সিটি করপোরেশনের কাছে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ইভেন্ট ছিল কোরবানি। আমরা কোরবানির বর্জ্য অপসারণে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছি। কোরবানির আগেই আমরা আগের জমে থাকা বর্জ্য অপসারণ করেছি। মশা নিধনের কাজের জন্য আমাদের যে লোকবল আছে, সেটাও আমরা বর্জ্য অপসারণের কাজে ব্যবহার করেছি। এবার আমরা বড় আঙ্গিকে মশা নিধনের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করব।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১০৭ জন। আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৪ হাজার ৮২ জন। আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের তালিকাভুক্ত করে এ হিসাব দিয়েছিল সিভিল সার্জনের কার্যালয়। তবে যারা আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিয়েছিলেন, তারা তালিকাভুক্ত হলে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে যেত বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
এদিকে চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি থেকে মে) আক্রান্ত হয়েছেন ১৬৯ জন। জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা মুঈন মাশুক জানিয়েছেন, আক্রান্তদের মধ্যে তিনজন মারা গেছেন।
২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তদের নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা। এতে বলা হয়, চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীদের ৬৫ শতাংশ পুরুষ, প্রতি পাঁচজনে একজন শিশু। আক্রান্ত শিশুদের বেশির ভাগই শহরে বাস করে।
জানা গেছে, ২০২১ সালে চট্টগ্রামে ২৭১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। মারা গিয়েছিলেন পাঁচজন। ২০২২ সাল থেকে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। ওই বছর চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরী মিলিয়ে পাঁচ হাজার ৪৪৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। মৃত্যু হয়েছিল ৪১ জনের। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুর চিত্র ভয়ংকর আকার ধারণ করে। আক্রান্তের সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেড়ে যায়।
এ বছরও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ে শঙ্কিত নগরবাসী, যার প্রতিফলন দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর ফেসবুক পেজের যেকোনো পোস্টেই মশা মারার আকুতি জানান নেটিজেনরা।
নগরীর আসকারদিঘীর পাড়ের বাসিন্দা তানভীর ইলাহি বলেন, আমাদের বিল্ডিংয়ের সঙ্গে লাগোয়া নালায় জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ চলছে। দুই বছর ধরে সিডিএ বাঁধ দিয়ে রেখেছে। ময়লা-আর্বজনা জমে আছে। বারবার বলার পরও বাঁধ সরানো হচ্ছে না। বৃষ্টি হলেই বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে যায়। সেই পানি বিভিন্ন গর্তে, বিল্ডিংয়ের কোণায় জমে থাকে। আবার সিটি করপোরেশন বলছে, জমে থাকা পানিতে মশা হবে। তাহলে আমরা কোথায় যাব? আমরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে এ দায় কার?
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী বলেন, গত তিন বছরের মধ্যে গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি একেবারে আমাদের সব ধারণাকে ছাড়িয়ে যায়। আমরা যদি সচেতন না হই, তাহলে এ বছর কী পরিস্থিতি হবে, সেটা ভবিষ্যতই বলতে পারবে। তবে ভালো কিছু যে হবে না, সেটা সহজেই অনুমেয়।
নগরবাসীর অভিযোগ, কেবল ডেঙ্গুর প্রকোপ চরম আকার ধারণ করলেই সিটি করপোরেশন মশা নিধনের তোড়জোড় শুরু করে। কিন্তু ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমলে তারা আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার মৌসুম চলে গেলে তখন মশার উপদ্রব বাড়লেও সিটি করপোরেশন লোক দেখানো কিছু কর্মসূচি ছাড়া আর কিছুই করে না। অথচ বছরজুড়ে মশা নিধনের কর্মসূচি চালু রাখলে নগরবাসী স্বস্তি পেত।
সর্বশেষ গত ৩০ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী নগরীর ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে মশা নিধনের কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেই কর্মসূচি বর্ষার আগ পর্যন্ত প্রতি ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে নিয়মিত করার কথা ছিল। কিন্তু ওষুধস্বল্পতা ও পরে এ খাতের কর্মীরা কোরবানির বর্জ্য অপসারণের প্রস্তুতির কাজে যুক্ত হয়ে যাওয়ায় মশা নিধনের কার্যক্রম থমকে যায়।
এ অবস্থায় গত দুই মাসে চসিকের মশা নিধনের কার্যক্রম কার্যত বন্ধ আছে। চসিকের কর্মকর্তারাই জানিয়েছেন, ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে নালা-নর্দমা আর ভবনের আশপাশে ওষুধ ছিটানো হলেও তা একেবারেই অপ্রতুল। রুটিন কাজের অংশ হিসেবে এটা করা হচ্ছে। এতে মশার উপদ্রব সেভাবে কমছে না।
তবে এবার ডেঙ্গু মোকাবিলার প্রস্তুতি গত বছরের চেয়ে ভালো বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উড়ন্ত বা পূর্ণবয়স্ক মশা এবং লার্ভা নিধনের জন্য তিন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয় লার্ভা মারার জন্য।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, চসিকের কাছে এ মুহুর্তে ২০ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইড ও তিন হাজার লিটার ফরমুলেশনবিহীন লার্ভিসাইড (লার্ভা মারার ওষুধ) মজুত আছে। ১৬ হাজার লিটার এলডিইউ (কালো তেল) মজুত আছে। এ ছাড়া ভেষজ ওষুধ ‘মসকুবার’ মজুত আছে ৮০০ লিটার। মশকনিধন কার্যক্রমে গতি আনতে ৬০টি ফগার মেশিন ও ১০০টি স্প্রে মেশিন কেনা হয়েছে।